অ্যানকাইলোসিং স্পনডাইলাটিস রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা
ডা: ইফতেখার হোসেন (বাঁধন)
প্রশ্নঃ
অ্যানকাইলোসিং স্পনডাইলাটিস (Ankylosing Spondylitis) কী?
উঃ অ্যানকাইলোসিং
স্পনডাইলাইটিস একটি প্রদাহ জনিত বাত রোগ। এটি মূলত: মেরুদন্ডকে আক্রমন করলেও বিশেষ
বিশেষ ক্ষেত্রে এটি অন্যান্য অস্থিসন্ধি, টেন্ডন
কিংবা লিগামেন্ট সমূহকেও আক্রান্ত করতে পারে।
প্রশ্নঃ
রোগটি কিভাবে হয়?
উঃ আমাদের শরীরের নিজস্ব
একটি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা আছে, এর মূল কাজ হল –
শরীরকে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা করা। কিন্তু এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন
অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে এবং নিজেই নিজের শরীরকে আক্রমণ করে বসে তখন এ জাতীয় রোগ
হয়। যেমন, ধরেন আপনি বাসায় দারোয়ান রাখলেন আপনাকে পাহাড়া
দেওয়ার জন্য, কিন্তু দারোয়ান যদি নিজেই আপনার সর্বনাশ
করতে আরম্ভ করে, তাহলে যেই পরিস্থিতি হবে, এই রোগটা অনেকটা সেরকম।
শরীরের যে সমস্ত স্থানে
টেন্ডন ও লিগামেন্টে সমূহ অস্থিসন্ধির সাথে বা এর আশেপাশে মিলিত হয়,
অ্যানকাইলোসিং স্পনডাইলাইটিস রোগে সেই সব স্থানে প্রদাহ (Inflammation)
ঘটে। পরবর্তীতে প্রদাহের স্থানে অস্থি ক্ষয়ে যায় এবং ক্রমান্বয়ে
এই সমস্ত জায়গায় নতুন অস্থি বৃদ্ধি হয়। টেন্ডন ও লিগামেন্ট সমূহের স্থিতিস্থাপকতা
হ্রাস পায় যেগুলো একসময় হাড়ে রূপান্তরিত হয়। এইভাবে এক বা একাধিক অস্থিসন্ধি এবং
মেরুদন্ডের হাড় সমূহ একটি আরেকটির সাথে জোড়া লেগে যায়। তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এই
জোড়া লাগার বিষয়টি আংশিকভাবে ঘটে যা কিনা কেবল মাত্র শ্রেণিচক্রের (Pelvic
Bones) অস্থি সমূহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। সমস্ত প্রক্রিয়ার
ফলাফল হলো, আক্রান্ত ব্যক্তির সচলতা হ্রাস পাওয়া এবং কোন
কোন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ পঙ্গুত্ব বরণ করা।
প্রশ্নঃ
এই রোগের উপসর্গ কী?
উঃ অ্যানকাইলোসিং
স্পনডাইলাইটিস রোগটি ধীরে ধীরে শুরু হয়। প্রথম দিকে ক্রমবর্ধমান কোমড়ে ব্যথা এবং
জড়তা থাকে যেটি দীর্ঘদিন (সপ্তাহ/মাস/বছর) পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। মাঝে মাঝে
রোগী শারীরিকভাবে কিছুটা আরাম রোধ করলেও, ব্যথা
সাধারনত পুরোপুরি উপশম হয় না।
এ রোগে কোমড়,
নিতম্ব এবং উরুর পেছনের অংশে ব্যথা হয়, এই
ব্যথার বিশেষত্ব হলো, এর তীব্রতা সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর
সবচাইতে বেশি থাকে এবং দিন বাড়ার সাথে সাথে হ্রাস পেতে থাকে। ব্যায়াম করলে এই
ব্যথার কিছুটা উপশম হয়, কিন্তু বিশ্রাম নিলে বেড়ে যায়।
অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে
রয়েছে: জ্বর জ্বর ভাব হওয়া, শরীরের ওজন
হ্রাস পাওয়া, রাতে ঘুম কম হওয়া, অবসন্নতা
ও দুর্বলতা, হার্টের ভাল্বের সমস্যা, চোখ প্রচন্ড ব্যথাসহ লাল হওয়া ইত্যাদি।
প্রশ্নঃ
রোগটা কি ভাল হবে?
উঃ আমাদের শরীরের কিছু কিছু
রোগ আছে যা এক কোর্স ঔষধ খেলেই সম্পূর্ণ ভাল হয়ে যায়,
যেমনঃ নিউমোনিয়া, যক্ষা ইত্যাদি।
আবার কিছু কিছু রোগ আছে,
যেমন ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ইত্যাদি, যা সবসময় ঔষধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে
হয়।
তেমনি এ রোগ সম্পূর্ণ
নির্মূল সম্ভব নয়, তবে আপনার কষ্ট লাঘব করার জন্য
এবং রোগটিকে নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে।
প্রশ্নঃ
চিকিৎসা না নিলে কী হবে?
উঃ এ রোগে যত দিন যায় ততই
মেরুদন্ডের নমনীয়তা হ্রাস পেতে থাকে। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে একসময় মেরুদন্ড
নমনীয় হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে শক্ত লাঠির মত হয়ে যেতে পারে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গুত্ব
বরণ করতে পারেন।
প্রশ্নঃ
বাংলাদেশে না হয় এ রোগ সুস্থ হওয়ার কোন চিকিৎসা নেই,
বাইরে কোথাও গেলে কি লাভ হবে?
উঃ পৃথিবীর কোথাও এ রোগ
নিরাময়ের চিকিৎসা নেই, কোথাও এরূপ চিকিৎসা আবিষ্কার
হলে অল্প সময়ের মধ্যেই তা বাংলাদেশেও চলে আসবে।
প্রশ্নঃ
এ রোগের জন্য কোন ডাক্তার দেখালে ভাল হবে?
উঃ এ রোগের চিকিৎসক হল
রিউমাটোলজিস্ট, রিউমাটোলজী (Rheumatology)
বিষয়ের উপর দক্ষতা আছে এমন যে কোন ডাক্তার আপনি দেখাতে পারেন।
প্রশ্নঃ
রোগটির চিকিৎসা সম্পর্কে কিছু বলুন-
উঃ এ রোগের চিকিৎসার ২টি দিক
আছে, এক - জীবন-যাত্রার কিছু নিয়ম বা অভ্যাসের
পরিবর্তন করা, দুই - ঔষধ সেবন।
নিয়মকানুনগুলো হলঃ
- ধুমপান বাদ দিতে হবে
- নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে, ব্যায়াম অ্যানকাইলোসিং স্পনডাইলাইটিস জনিত ব্যথার তীব্রতা কমায় এবং অস্থিসন্ধির নমনীয়তা বাড়ায়। সাঁতার ও সাইকেল চালানো হলো সবচাইতে আদর্শ ব্যায়াম
- কর্মব্যস্ত জীবন যাপনের চেষ্টা করতে হবে
- মানসিকভাবে প্রফুল্ল থাকার চেষ্টা করতে হবে
কীভাবে ব্যয়াম করবেন, তা নিচের ভিডিওতে দেখতে পারেনঃ
আর ঔষধকে প্রধানত ২ ভাগে ভাগ করা যায়, উপসর্গের চিকিৎসা এবং রোগের প্রক্রিয়াকে দাবিয়ে রাখার জন্য বাত নিয়ন্ত্রনকারী ঔষধ। ব্যথার জন্য ব্যথানাশক (NSAIDs), পাশাপাশি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটও দেওয়া লাগতে পারে। রোগের প্রক্রিয়াকে দাবিয়ে রাখার জন্য DMARDs (যেমন, SSZ, infliximab, adalimumab, certolizumab pegol, and golimumab, etanercept ইত্যাদি) দেওয়া লাগতে পারে।
আন্তর্জাতিক চিকিৎসা
সংস্থাগুলোর নির্দেশনা হল এ রোগে শুরুতে টানা ১৪ দিন নির্দিষ্ট কিছু ব্যথার ঔষধের
যেকোন ১টি সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করা, ১৪ দিনে
কিছুটা উন্নতি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ঔষধ চালিয়ে নেওয়া। আর ১৪ দিনে যদি
কোন উন্নতি না হয়, তাহলে অন্য আরেকটি ব্যথার ঔষধ একই ভাবে
১৪ দিন ব্যবহার করা। ব্যথার ঔষধে কাজ হলে পরবর্তীতে রোগের অবস্থা বুঝে চিকিৎসকের
পরামর্শমত ব্যথার ঔষধ বন্ধ করতে পারবেন। ব্যথার ঔষধে কাজ না হলে বাত নিয়ন্ত্রনকারী
ঔষধ (DMARDs) ব্যবহার করা হয়।
যদি কোন জয়েন্ট পুরোপুরি
জোড়া লেগে যায় তবে সার্জারির মাধ্যমে তা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
প্রশ্নঃ
ব্যাথার ঔষধ খেলে তো শুনেছি কিডনি নষ্ট হয়ে যায়!
উঃ ব্যাথার ঔষধে কিডনির যে
সমস্যাটা হয়, তা হল একিউট ইন্টারস্টেশিয়াল
নেফ্রাইটিস। কিন্তু ইন্টারস্টেশিয়াল নেফ্রাইটিস ব্যাথার ঔষধের জন্য যতটা না হয়,
তার চেয়ে বেশি হয় বিভিন্ন এন্টিবায়োটিকের জন্য, এমন কি গ্যাস্ট্রিকের ঔষধের জন্য। আর এ অসুখটি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
অন্যদিকে সবাই কিডনির যে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে তা হল "সি. কে. ডি.",
বাংলাদেশে যার ১ নম্বর কারন গ্লোমেরিউলোনেফ্রাইটিস, ২ নম্বর কারন ডায়বেটিস, ৩ নম্বর কারন উচ্চ
রক্ত চাপ। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে যে ব্যাথার ঔষধ শতকরা মাত্র ১-২ ভাগ
মানুষের কিডনির সমস্যা করে, কাজেই আপনি কি সেই ২ ভাগের
ভিতর পরবেন? নাকি বাকি ৯৮ ভাগের ভিতর পরবেন? তা আপনার ভাগ্য। তবে আপনি যদি সেই ২ ভাগের ভিতর পরেও থাকেন তবুও ভয়
পাওয়ার কারন নেই, কেননা আপনার কিডনির কোন সমস্যা হচ্ছে কি
না তা লক্ষ্য রাখতে আমরা নিয়মিত আপনাকে কিডনির মার্কার করে ফলোআপে আসতে বলব।
সংক্ষেপে বললে: আপনি যদি
চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক ব্যথার ঔষধ খান, তাহলে
আপনার ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। আর যদি ঘরে বসে নিজে নিজে বছরের পর বছর ব্যথার
ঔষধ খেতে থাকেন তাহলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
প্রশ্নঃ
ঔষধ খেলে কি সবসময় ভাল থাকব?
উঃ কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঔষধ
খাওয়া অবস্থায়ও এ রোগের তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে
চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ঔষধের মাত্রা পরিবর্তন করা লাগতে পারে।
প্রশ্নঃ
এই রোগের রুগীদেরকে ডাক্তাররা ২-৩ মাস পরপর ফলোআপে আসতে বলেন কেন?
উঃ ঔষধের জন্য কিছু কিছু
মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হয়- যেমন কিডনি,
অন্ত্র, লিভারের সমস্যা হওয়া, রক্ত কমে যাওয়া ইত্যাদি। আপনার ক্ষেত্রে কোন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে
কিনা তা নির্ণয় করতে এবং রোগের কারনে আপনার নতুন কোন সমস্যা হচ্ছে কনা তা নির্ণয়
করতে আপনাকে নিয়মিত ফলোআপে আসতে হবে। শুরুর দিকে ২ সপ্তাহ পরপর, তারপর ১ মাস পরপর, পরবর্তীতে ৩ মাস পরপর
ফলোআপে আসতে হবে। ফলোআপের সময় কিছু পরীক্ষা যেমন, রক্তের
সিবিসি, কিডনির মার্কার, লিভারের
মার্কার ইত্যাদি করে চিকিৎসককে রিপোর্ট দেখাতে হবে।
প্রশ্নঃ
এই রোগের রুগীদেরকে ডাক্তাররা টিকা নিতে বলেন কেন?
উঃ এই রোগে কিছু সংক্রামক
ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়, তাছাড়া রোগটিকে
নিয়ন্ত্রণ করতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় এমন ঔষধ ব্যবহার করতে হয়, সেক্ষেত্রেও সংক্রামক ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কাটা বেড়ে যায়।
তাই নিয়মিত কিছু কমন
সংক্রামক ব্যাধির টিকা নিতে হবে, যেমনঃ
- পাঁচ বছর পরপর নিউমোকক্কাল ভ্যাক্সিন
- প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাক্সিন
- হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন ইত্যাদি
--- ধন্যবাদ ---
================================== RheumaLife =================================
=================================== iCarePG ===================================
No comments:
Post a Comment